সংবিধান সংস্কার কমিশনে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে আত্মস্বীকৃত রাজাকার-পুত্র ও চাকমা সার্কেল চিফ দেবাশীষ রায়ের নাম। বিশ্বস্ত সূত্রে তার নিয়োগের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। সূত্র জানায়, খুব দ্রুতই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি হবে। এর আগে দেশ বিরোধী এমন অপরাধীর পুত্রের 'সার্কেল চিফ' হওয়া নিয়েও সমালোচনা আছে।
দেবাশীষ রায় পেশায় একজন ব্যারিস্টার। তিনি ২০০৬-২০০৮ সালে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী হিসাবে কাজ করেছেন। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। এই পদে দায়িত্ব পালনের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে পরবর্তীতে তিনি জাতিসংঘের স্থায়ী ফোরামে আদিবাসী বিষয়ক সদস্য হন।
১৯৭১ সালে যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে পরাজয় নিশ্চিত ভেবে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে পাকিস্তানে আশ্রয় নেয় দেবাশীষ রায়ের বাবা তথা চাকমা সার্কেলের ৫০ তম চিফ ত্রিদিব রায়। ত্রিদিব রায়ের অনুপস্থিতিতে ১৯৭৭ সালে নিজেকে চাকমা সার্কেলের চিফ বলে ঘোষণা দেন দেবাশীষ রায়।
ত্রিদিব রায় মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত এক চাকমা নেতা। তার বুদ্ধি ও সহযোগিতায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী রাঙ্গামাটিতে চুপিসারে অবস্থান নেয়। ওই অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে খুঁজে বের করে নির্মমভাবে হত্যা করে। ত্রিদিব রায়ের প্রত্যক্ষ ভূমিকায় হানাদার বাহিনীর আক্রমণে জীবন হারান বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক মুন্সী আবদুর রবসহ আরও অসংখ্য উপজাতি ও বাঙালি মুক্তিযোদ্ধা।
বরাবরই বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী ত্রিদিব রায় ও তার রাজাকার বাহিনীর সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে পাক বাহিনী একের পর এক হামলা পরিচালনা করে। কয়েকটি অপারেশনে ত্রিদিব রায় নিজেই নেতৃত্ব দিয়েছেন।
১৯৭১ সালের নভেম্বরে ত্রিদিব রায় পাকিস্তানি সৈন্যদের সহায়তায় মিয়ানমার হয়ে পাকিস্তানে পালিয়ে যাওয়ার পর পাকিস্তান সরকার তাকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিশেষ দূত হিসেবে ওই বছরই ব্যাংকক পাঠায়। বিশেষ দূত নিযুক্ত হয়ে চতুর এই ব্যক্তি নিজের ধর্ম পরিচয় কাজে লাগিয়ে পাকিস্তানের পক্ষে জনমত গঠনে এ অঞ্চলের বৌদ্ধপ্রধান রাষ্ট্রগুলো চষে বেড়ান।
জাতিসংঘের ১৯৭২ সালে জেনারেল এ্যাসেম্বলিতে বাংলাদেশের সদস্য পদ প্রদানের প্রসঙ্গ উত্থাপিত হওয়ার পর তার বিরোধিতা করার জন্য পাকিস্তান সরকার ত্রিদিব রায়কে প্রধান করে একটি প্রতিনিধিদল পাঠায়। তবে সেখানে তার ঘোর বিরোধিতা স্বত্বেও বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হিসেবে জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভ করে।
বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর পাকিস্তান সরকার তাকে সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বানায়। অতি আনুগত্যের কারণে পাকিস্তান সরকার তাকে সে দেশের আজীবন ফেডারেল মন্ত্রীর মর্যাদা দেয়। যা তাকে ‘উজিরে খামাখা’ হিসেবে পরিচিত করে তোলে।
১৯৮১ সাল থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত ত্রিদিব রায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হিসেবে আর্জেন্টিনা, শ্রীলঙ্কা, চিলি, ইকুয়েডর, পেরু ও উরুগুয়ের কাজ করেছেন। ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বিদেশে অবস্থান করার পর তিনি চূড়ান্তভাবে পাকিস্তানেই ফিরে আসেন। এরপর থেকে তিনি সেদেশের 'এম্বেসেডর এট লার্জ' ছিলেন। পাকিস্তান প্রীতির জন্য ভুট্টো প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি রাষ্ট্রপতি হওয়ার প্রস্তাব পেয়েছিলেন। পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি হতে হলে মুসলিম হতে হবে বিধায় ত্রিদিব রায় সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। ২০১২ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের এ বিরোধিতাকারীর মৃত্যু হয় এবং পাকিস্তানের মাটিতেই তার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এ নিয়ে কোনো অনুতাপ স্বীকার করেননি। বরং মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ব্যঙ্গ করে গেছেন।
জানা যায়, পিতার মতো দেবাশীষ রায়ের স্বপ্ন বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা নিয়ে একটি স্বতন্ত্র রাজ্য গঠনের স্বপ্ন দেখেন তিনি। পাহাড়ের উগ্র গোষ্ঠীগুলোর কথিত 'জুম্মল্যান্ড' গঠনের সাথে তিনি একাত্মতা প্রকাশ করেন বলেও জানা যায়। দীর্ঘ সময় ধরে বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন তিনি। ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপির সাথেও তার সখ্যতার খবর পাওয়া যায়। তিনি প্রকাশ্যেই পার্বত্য অঞ্চলে স্বায়ত্বশাসনের দাবি তুলেছেন। ২০২১ সালের ৯ আগস্ট ভয়েস অব আমেরিকা পত্রিকার বাংলা ভার্সনের প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, 'সংবিধানকে সংস্কার করে পাবর্ত্য চট্টগ্রামের বিশেষ প্রশাসনিক মর্যাদার সংরক্ষণ এবং পাবর্ত্যাঞ্চলসহ দেশের সকল আদিবাসী জাতিসমূহের পরিচয়, স্বকীয়তা ও ঐতিহ্যের স্বীকৃতি' দিতে হবে। অর্থাৎ নিজের বাবার মতো তিনিও পাহাড়ে স্বায়ত্বশাসিত রাজ্য গঠনের নামে নিজের আধিপত্য ধরে রাখতে চান। সুযোগ বুঝে অস্থিরতা সৃষ্টির মাধ্যমে দীর্ঘদিনের লালিত কাল্পনিক 'জুম্মল্যান্ড' গঠনের বাস্তব রূপ দিতে চান। এ সাক্ষাৎকারে তিনি তার এই স্বপ্নের বাঁধা সেনাবাহিনীকে পাহাড় থেকে অপসারণের দাবি করেন।
দেশবিরোধী এই ত্রিদিব রায়ের ছেলেকে সংবিধান সংস্কার কাজে অন্তর্ভুক্ত করার খবরে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশিষ্টজনরা। এই সিদ্ধান্তকে সরকারের 'আত্মঘাতী' সিদ্ধান্ত বলে দাবি করেছেন তারা। প্রশ্নবিদ্ধ এ নিয়োগকে কেন্দ্র করে পার্বত্য অঞ্চলসহ সারাদেশেই অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে।
-পার্বত্য সময়