অস্ট্রেলিয়ার হাজার বছরের ইতিহাস বনাম পার্বত্য চট্টগ্রামের অভিবাসনের প্রেক্ষাপট

অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী ও বাংলাদেশের উপজাতি: একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ

বিশ্বের আদিবাসী জাতিসত্তার বাস্তবতা নিয়ে বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়ার প্রেক্ষাপটে একটি ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণ।

বিশেষ প্রতিবেদন
২৩ জুন, ২০২৫ এ ১৯:৫১
অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী ও বাংলাদেশের উপজাতি: একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ

অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী ও বাংলাদেশের উপজাতি


বিশ্বজুড়ে আদিবাসী জাতিসত্তার প্রশ্ন এক গভীর ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক আলোচনার বিষয়। যারা প্রকৃত অর্থে আদিবাসী, তাদের ইতিহাস যুগ-যুগান্তরের, তাদের সংস্কৃতি পৃথিবীর প্রাচীনতম মানবিক অভিব্যক্তির ধারক। কিন্তু সেই পরিচয় যখন রাজনৈতিক এজেন্ডা ও ভূরাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে ব্যবহৃত হয়, তখন ‘আদিবাসী’ শব্দটি হারায় তার আভিজাত্য, জটিল করে তোলে জাতীয় সংহতির ভিত্তি। আজকের আলোচনার কেন্দ্রে তাই উঠে আসে দুটি অঞ্চল: অস্ট্রেলিয়ার মূল ভূখণ্ড এবং বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম।

 

অস্ট্রেলিয়ার অ্যাবোরিজিনাল 

অস্ট্রেলিয়ার অ্যাবোরিজিনাল এবং টরেস স্ট্রেইট আইল্যান্ডারস জনগোষ্ঠী মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক বিস্ময়। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা বলছে, তারা এই মহাদেশে বসবাস করছেন কমপক্ষে ৬০,০০০ বছর ধরে, মানব ইতিহাসের প্রাচীনতম অবিরত সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার।

টরেস স্ট্রেইট আইল্যান্ডারস জনগোষ্ঠী
টরেস স্ট্রেইট আইল্যান্ডারস জনগোষ্ঠী

অ্যাবোরিজিনাল জনগোষ্ঠী অস্ট্রেলিয়ার বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে থাকা শত শত গোত্র নিয়ে গঠিত, যাদের জীবনধারা আবদ্ধ ছিল প্রাকৃতিক নিয়ম ও আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যার সঙ্গে। তাদের 'ড্রিমটাইম' ধারণা শুধু কোনো পৌরাণিক কাহিনি নয়—এ এক পরম্পরাগত ইতিহাস, অস্তিত্বের নৈতিক কাঠামো। তারা পৃথিবী, আকাশ, প্রাণীজগত ও মানবসমাজের সৃষ্টি এবং পারস্পরিক সম্পর্ককে ব্যাখ্যা করে একটি সাংস্কৃতিক গীতিমালায়।

টরেস স্ট্রেইট আইল্যান্ডারস জনগোষ্ঠী

টরেস স্ট্রেইট আইল্যান্ডারস জনগোষ্ঠী অ্যাবোরিজিনালদের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন। কুইন্সল্যান্ডের উত্তরের দ্বীপগুলোতে বসবাসকারী এই জনগোষ্ঠীর শিকড় মেলানেশিয়া ও পলিনেশিয়ায়, যারা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সমুদ্রজীবন, মাছ ধরা, গান, নৃত্য, নৌযান নির্মাণের মধ্য দিয়ে গড়ে তুলেছে স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি।

 

বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি: অভিবাসনের ইতিহাস

বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্তমানে ১১টি স্বীকৃত উপজাতি জনগোষ্ঠী বাস করে- চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, ম্রো, তঞ্চঙ্গ্যা, লুসাই, খিয়াং, খুমি, বম, পাংখোয়া এবং চাক। কিন্তু তাদের বসবাসের ইতিহাস স্মরণাতীত নয়; বরং ইতিহাসে সুস্পষ্টভাবে দলিলবদ্ধ অভিবাসনের রূপরেখা রয়েছে।

বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি জনগোষ্ঠী

চাকমারা এসেছে মূলত আরাকান (বর্তমান মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য) অঞ্চল থেকে ১৬শ শতাব্দীর দিকে, ব্রিটিশ শাসনের সময় তারা রাঙামাটিতে স্থানান্তরিত হয়। মারমারা এসেছে ১৬৩৮ সালে বার্মার পেগু অঞ্চল থেকে। ত্রিপুরারা এসেছে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে ১৮শ শতকের মাঝামাঝি সময়ে। অন্যরাও এসেছে থাইল্যান্ড, চীন ও উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে।

অর্থাৎ, এরা এই অঞ্চলের আদি বাসিন্দা নয়; বরং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক অস্থিরতা, যুদ্ধ ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে অভিবাসিত হয়েছে। তাদের বসবাসের সময়কাল গড়ে ৩০০ থেকে ৫০০ বছরের মধ্যে সীমাবদ্ধ।

তুলনামূলক বিশ্লেষণ: কে আদিবাসী, কে অভিবাসী?

জাতিসংঘের আদিবাসী সংজ্ঞা (UNDRIP) অনুযায়ী, আদিবাসী বলতে এমন জনগোষ্ঠীকে বোঝায় যারা:

একটি অঞ্চলে স্মরণাতীতকাল ধরে বসবাস করছে,

স্বতন্ত্র ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় বিশ্বাস ধারণ করে,

নিজেদের ঐতিহ্য ও সামাজিক কাঠামো বজায় রেখেছে,

ঔপনিবেশিক বা বহিরাগত আগ্রাসনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং

বর্তমানে রাষ্ট্র দ্বারা প্রান্তিক অবস্থানে রয়েছে।

অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা এই সংজ্ঞার প্রতিটি শর্ত পূরণ করে। তাদের ইতিহাস হাজার হাজার বছর পুরনো, ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের ফলে তারা নিপীড়নের শিকার হয়েছে, এবং বর্তমানে আইনি ও সামাজিক স্বীকৃতি পেয়েছে।

অন্যদিকে, পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের ইতিহাস একটি অভিবাসী অধ্যায়। তারা ৩০০–৫০০ বছর আগে এসেছেন, এবং এই অঞ্চলের পূর্বতন বসতি ছিল নৃতাত্ত্বিকভাবে ভিন্ন জনগোষ্ঠীর। এই কারণে রাষ্ট্রপক্ষ (বাংলাদেশ সরকার) তাদের "আদিবাসী" নয়, বরং "উপজাতি" বা "ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী" হিসেবে অভিহিত করে। সংবিধানের ২৩(ক) অনুচ্ছেদে উপজাতি জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি রক্ষার কথা বলা হলেও, কোথাও "আদিবাসী" শব্দের স্বীকৃতি নেই।

 

আদিবাসী দাবির অন্তরালে রাজনৈতিক প্রকল্প

তাহলে প্রশ্ন জাগে—উপজাতিরা কেন নিজেদের আদিবাসী হিসেবে পরিচয় দিতে আগ্রহী? বিশ্লেষকদের মতে, আদিবাসী পরিচয় আন্তর্জাতিক পরিসরে অনেক সুবিধা বয়ে আনে। জাতিসংঘের আদিবাসী অধিকার ঘোষণাপত্র (UNDRIP) অনুযায়ী আদিবাসীরা:

ভূমির উপর স্বতন্ত্র অধিকার দাবি করতে পারে, স্ব-শাসন ও পৃথক প্রশাসনিক কাঠামোর দাবি জানাতে পারে এবং আন্তর্জাতিক সহায়তা ও অনুদান পেতে সক্ষম হয়।

এই বাস্তবতায় দেখা যায়, কিছু আন্তর্জাতিক এনজিও, ধর্মীয় মিশনারি গোষ্ঠী এবং বিদেশি রাজনৈতিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট গোষ্ঠী এই দাবিকে উসকে দেয়। তাদের উদ্দেশ্য, এই অঞ্চলে একটি বর্ণনাভিত্তিক স্বতন্ত্র জাতিগোষ্ঠী তৈরি করা, যা ভবিষ্যতে স্বশাসন বা বিচ্ছিন্নতার প্ল্যাটফর্মে রূপ নিতে পারে।

‘আদিবাসী’ পরিচয় নিছক একটি সাংবিধানিক বা আন্তর্জাতিক ট্যাগ নয়- এটি একটি ইতিহাসনির্ভর, শিকড়-বিষয়ক দাবি। অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা সেই দাবির পূর্ণাঙ্গ অধিকার রাখে, কারণ তাদের শিকড় গাঁথা আছে ওই অস্ট্রেলিয়ার মাটির গভীরে, আদি ইতিহাসের অন্ধকার গহ্বরে। বাংলাদেশের উপজাতিরা অবশ্যই দেশের নাগরিক, তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, জীবনযাত্রা রাষ্ট্রের সম্পদ। কিন্তু ইতিহাসকে পাশ কাটিয়ে কৃত্রিমভাবে "আদিবাসী" দাবি করা শুধু ইতিহাসের অপব্যবহার নয়, জাতীয় সংহতিরও অন্তরায়। এ দাবি যখন উসকে দেয় বিদেশি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী, তখন তা শুধু ভুল নয়, বিপজ্জনক।

- মইনুল ইসলাম, শিক্ষক ও গবেষক


সংবাদটি শেয়ার করুন

মন্তব্য


আপনাকে মন্তব্য করতে হলে লগইন করতে হবে

পার্বত্য চট্টগ্রাম কাটাগরির আরও খবর পড়ুন

ad