নিরাপদ ত্রাণ, প্রত্যাবাসন ও মানবিক সহায়তার এক নতুন ধারণা হিসেবে ‘মানবিক করিডোর’ রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে কতটা কার্যকরী হবে, তা নিয়ে আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে বহু আলোচনার জন্ম হয়েছে। বর্তমান সময়ে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাত, আরাকান ও রাখাইন অঞ্চলের অস্থিতিশীলতা এবং সশস্ত্র জটিলতা—এসব কারণে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন ও তাদের মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করা একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ প্রসঙ্গে মানবিক করিডোরের ধারণা, বাংলাদেশের এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে এক নতুন আলোচনার সূচনা করেছে, যা ব্যাপক সমর্থন ও বিতর্ক উভয়েরই মুখে রয়েছে।
মানবিক করিডোর বলতে বোঝায় এমন একটি নির্দিষ্ট পথ বা নেটওয়ার্ক, যার মাধ্যমে মানবিক সহায়তা, ত্রাণ সামগ্রী ও চিকিৎসাসেবা দ্রুত ও নিরবচ্ছিন্নভাবে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে পৌঁছানো যায়। রোহিঙ্গা সংকটের প্রেক্ষাপটে, এই ধারণাটি মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সহিংসতা ও অব্যবস্থাপনার মাঝে নিরাপদ সহায়তার ব্যবস্থা গড়ে তোলার একটি চেষ্টা হিসেবে দেখা হচ্ছে। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসও কয়েকটি সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, “মানবিক সহায়তার জন্য অনুমোদন ও সহযোগিতা প্রয়োজন, যাতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সহজতর হয়”।
বাংলাদেশ বর্তমানে প্রায় সাড়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিচ্ছে, এই সংকট মোকাবেলায় একদিকে মানবিক সহায়তার ব্যয় বহন করছে, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সমর্থনের জন্য নানা কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাত ও সীমান্তের জটিলতা- বিশেষ করে রাখাইনের অবস্থা এই মানবিক করিডোরের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। সাম্প্রতিক সংবাদ অনুযায়ী, রাখাইনে চলমান অস্থিতিশীলতা, সরবরাহের সীমাবদ্ধতা এবং আরাকান আর্মির দ্বারা সরবরাহ আটকে দেওয়ার কারণে, বাংলাদেশ থেকে মানবিক সহায়তা পাঠানোর উদ্যোগ অনেক ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
কিন্তু মানবিক করিডোর বাস্তবে যদি সুসংগঠিত ও সম্মিলিত উদ্যোগ হিসেবে গড়ে ওঠে, তবে এটি রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে অনেকাংশে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। প্রথমত, এটি সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার প্রক্রিয়াকে দ্রুত ও কার্যকর করে তুলবে। যেহেতু রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে খাদ্য, ওষুধ, পানি ও আশ্রয় সংক্রান্ত সমস্যা ব্যাপক, মানবিক করিডোরের মাধ্যমে এগুলো সরবরাহ করা গেলে তাদের জীবিকা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। দ্বিতীয়ত, একটি নির্দিষ্ট ও নিয়ন্ত্রিত করিডোর থাকলে, অবৈধ সরবরাহ, মাদক ও অস্ত্র পাচার প্রতিরোধেও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া যাবে। তবে এই ধরণের পদক্ষেপ গ্রহণের আগে, সরকারের এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে সমন্বয় ও সহযোগিতা জরুরি।
বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে বলা যায়, রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় শুধুমাত্র অভ্যন্তরীণ মানবিক সহায়তার উপর নির্ভর করা যথেষ্ট নয়; বরং এটি একটি আন্তঃসীমান্ত সমস্যা, যার জন্য আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক চাপ ও সহযোগিতা অপরিহার্য। জাতিসংঘ, ইউএস, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো দেশগুলি ইতিমধ্যে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছে। তবে এই সহায়তা যদি মানবিক করিডোরের মাধ্যমে সঠিকভাবে প্রয়োগ করা যায়, তবে তা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া এবং তাদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টিতে, মানবিক করিডোর শুধু সরবরাহের পথ নয়, বরং এটি একটি রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক হাতিয়ার হিসেবেও কাজ করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, জাতিসংঘ মহাসচিব গুতেরেস বলেছেন, “রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনের জন্য আমাদেরকে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে মানবিক সহায়তা জোরদার করতে হবে, এবং যদি পরিস্থিতি অনুকূল হয়, তাহলে বাংলাদেশ থেকেও একটি মানবিক করিডোর থাকা উচিত”। এর ফলে, এই ধারণাটি শুধু মানবিক সহায়তার প্রসার নয়, বরং একটি কূটনৈতিক উদ্যোগ হিসেবেও বিবেচিত হতে পারে, যা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া ও দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে।
তবে মানবিক করিডোর বাস্তবায়নে বেশ কিছু বাধা ও ঝুঁকি রয়েছে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাত, সীমান্ত নিরাপত্তা ও আরাকান আর্মির অব্যবস্থাপনা এই উদ্যোগকে জটিল করে তুলছে। দেশটির অভ্যন্তরে যদি শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা যায়, তবে মানবিক করিডোরের সফল বাস্তবায়ন সম্ভব হতে পারে; কিন্তু এই শান্তি ফিরিয়ে আনা সহজ নয়। পাশাপাশি, করিডোরের মাধ্যমে প্রেরিত সহায়তার সঠিক বন্টন, তা আদায় ও পরিচালনার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও দায়িত্বশীলতার অভাব থাকলে, তা শুধুমাত্র সাময়িক ও প্রতীকী সহায়তায় পরিণত হবে।
একই সাথে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বাংলাদেশের ভূমিকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া সফল করতে, বাংলাদেশের সরকারের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দাতা সংস্থার সহযোগিতা ও সমর্থন অপরিহার্য। জাতিসংঘ মহাসচিব, আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক কূটনীতিবিদরা বলছেন, “রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে একটি বহুমুখী এবং সমন্বিত পদক্ষেপ অপরিহার্য, যার মধ্যে মানবিক করিডোর একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান”।
বর্তমানে, জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানে নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা ও সম্মেলন আয়োজন করছে। তবে, এই আলোচনা ও সম্মেলনের ফলাফল যদি কেবল কাগজে সীমাবদ্ধ থেকে যায়, তাহলে মানবিক করিডোর বাস্তবে কোনো প্রভাব ফেলতে পারবে না। বাংলাদেশ, মিয়ানমার এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট পক্ষকে একত্রে নিয়ে একটি কার্যকরী, সুসংগঠিত ও স্বচ্ছ মানবিক করিডোর তৈরি করতে হবে, যাতে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও মানবিক অধিকার নিশ্চিত করা যায়।
সবশেষে, মানবিক করিডোরের ধারণাটি, যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়, তবে তা রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে পারে। তবে এ উদ্যোগের সফলতা নির্ভর করবে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ শান্তি, এবং সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের আন্তঃসীমান্ত সমন্বয়ের ওপর। রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন ও তাদের মৌলিক মানবিক অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে, মানবিক করিডোর কেবল একটি প্রযুক্তিগত ও মানবিক উদ্যোগ নয়, বরং এটি একটি রাজনৈতিক সংকল্প ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের একত্রিত প্রচেষ্টার প্রতীক হয়ে উঠতে পারে।
-মঈনুল ইসলাম, শিক্ষক ও গবেষক
মানবিক করিডোর, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে প্রভাব রাখবে?
রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মানবিক করিডোরের ধারণা কতটা কার্যকর হবে? আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টিভঙ্গি, বাংলাদেশের ভূমিকাসহ সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ ও সমাধান বিশ্লেষণ।
বিশেষ প্রতিবেদন
২৩ মার্চ, ২০২৫ এ ১৯:১২

ছবি: সংগৃহীত